ময়মনসিংহ ১২:৫০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এবার জেগে ওঠো, বন্ধু!

অলংকরণ: প্রতিদিনের ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ: ১৯৭১ সালে মধ্যবিত্তদের নেতৃত্বে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অপরিসীম ত্যাগ এবং সাহসী লড়াইয়ের ফলশ্রুতিতেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে উচ্চবিত্তদের হাতে।

মিলিটারি শাসিত ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান রাষ্ট্র জিম্মি ছিলো উচ্চবিত্ত ২২ টি পরিবারের হাতে। সেই জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেতেই মধ্যবিত্ত বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণ মতান্তরে প্রজাশাসিত স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল।

অথচ, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ৫০ বছর বয়সী স্বাধীন বাংলাদেশ পুনরায় কতিপয় উচ্চবিত্তের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে; পাকিস্তানের ২২ পরিবারের জায়গায় বড়জোড় স্বাধীন বাংলাদেশের ২২০ পরিবার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে মাত্র।

রাষ্ট্র পরিচালনায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ কেবল ৫ বছর পর পর ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় কতিপয় উচ্চবিত্ত প্রতিনিধি নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ কেমন স্বাধীনতা? এ কেমন মুক্তি? নিম্নবিত্তরা তো আজও কামলা দিয়েই খায়! মধ্যবিত্তের হাঁড়িতে তো আজও অনটন লেগেই আছে! কৃষক-শ্রমিক তো আজও ক্রমাগত নিষ্পেষিত হচ্ছে! বেকারত্ব-হতাশায় নিমজ্জিত কোটি কোটি তরুণ! উচ্চবিত্তের চাপিয়ে দেয়া “নিপীড়নমূলক অর্থনীতি” আজও দুঃখী বাঙালির রক্ত চুষে নিচ্ছে!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা এখন উচ্চবিত্তের সার্কেলে বন্দী। নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের হাহাকার চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গণভবনের চারদিকে ঘিরে থাকা উচ্চবিত্তের দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করতে পারে না। শুধু শেখ হাসিনা কেন? স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সামরিক ক্যান্টনমেন্টে যে দুটি বৃহৎ দলের জন্ম হয়েছে, তাদেরও তো একই অবস্থা! কিংবা অন্য যেকোনো রাজনৈতিক দল -সবখানেই তো উচ্চবিত্তের আস্ফালন! বারিধারার অভিজাত প্রেসিডেন্ট পার্কে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কেন্দ্রে মানুষের স্থান কোথায়? লন্ডনের বিলাসবহুল জীবনে বসে তারেক রহমান ঘটাবেন বাঙালি কৃষকের মুক্তি? মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারখেকো মোল্লারা তো স্বর্গের দিবাস্বপ্নেই বিভোর! ভিনদেশী অর্থায়নে সমাজতান্ত্রিক নেতারাও তো রাজধানীর ফ্ল্যাটে-ফ্ল্যাটে বিপ্লব করছেন!

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্য স্মরণকালের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। উচ্চবিত্তের প্রভাব এতটাই প্রকট হয়েছে যে, প্রত্যন্ত পল্লী গ্রামের একজন মেম্বারকেও ১৫-২০ লাখ টাকা খরচ করে নির্বাচিত হতে হয়, দেশের যেকোনো প্রান্তের একজন ইউপি চেয়ারম্যানের ন্যুনতম নির্বাচনী খরচ এক থেকে দেড় কোটি টাকায় উঠে গেছে, একজন এমপিকে অনায়াসে ৫-১০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়!

রাষ্ট্রকে উচ্চবিত্তের নিয়ন্ত্রণে নিতে দলীয় মনোনয়ন নামক তামাশার আবির্ভাব ঘটেছে। নির্বাচনের আগেই উচ্চবিত্তের টাকার কাছে মনোনয়ন বিক্রি হওয়ায় নিপীড়িত জনতার রায় উপেক্ষিত হচ্ছে। দেশের একদম রুট লেভেল থেকে রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ ঘটিয়ে উচ্চবিত্তের সিন্ডিকেট জিম্মি করে রেখেছে আপামর জনসাধারণকে।

এসব কারণে সরকারের কোনক্ষেত্রেই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোন অবস্থান নেই। চাকুরী করতে গেলে লেখাপড়ায় যে উচ্চখরচ কিংবা যে ঘুষ দিতে হয় -তা যোগানের সুযোগ সমাজের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষের নেই বিধায় সমস্ত ভাল ভাল চাকরির বাজারও ক্রমান্বয়ে উচ্চবিত্তের দখলে চলে যাচ্ছে। নিম্নবিত্তের সন্তানেরা-মধ্যবিত্তের সন্তানেরা বড়জোর গার্মেন্টস শ্রমিক, এনজিও কর্মী, ব্যাংকের ক্লার্ক কিংবা কেজি স্কুলের মাস্টারিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে। আর, এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ঘুরেফিরে সীমাবদ্ধ কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারের হাতেই।

কিন্তু, বন্ধু, এমন তো কথা ছিলো না! ১৯৭১ সালে দেশের গরীব ছেলে-মেয়েরা জীবন দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন তো এজন্য করে যাননি! ওরা শহরে বসে দামী বাড়িতে থাকবে, দামী গাড়িতে ঘুরবে, বিলাসী জীবন যাপন করবে আর দেশের মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হাঁস-ফাঁস করবে, বেকারত্বের অভিশাপে প্রজন্ম নিষ্পেষিত হবে, চিকিৎসার অভাবে নিরীহ মানুষ মরবে -এমন শর্তে তো একাত্তরের যুদ্ধটা করেননি!

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিক-বেকারের মুক্তির জন্য, নিম্নবিত্তের মুক্তির জন্য, মধ্যবিত্তের মুক্তির জন্য -প্রজন্মকে ভাবতে হবে। উচ্চবিত্ত রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের ঘুমপাড়ানি গানে ঘুমিয়ে না থেকে প্রবল বিক্রমে ঐক্যবদ্ধভাবে জেগে উঠতে হবে। সমস্ত শৃঙ্খল ভেঙে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য উচ্চবিত্তের কোষাগারে প্রবলভাবে আঘাত হানতে হবে। প্রত্যেক গ্রামে এই উচ্চবিত্ত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হবে।

একাত্তরের সাতই মার্চে জনকের সেই উদাত্ত আহবান -“এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”। সেই মুক্তির জন্য সংগ্রাম শেষ হয়নি, বন্ধু! সে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হও। নিজেদের তৈরি কর। মুক্তি আসন্ন।

আর ঘুমিয়ে থাকার সময় নেই, বন্ধু! এবার জেগে ওঠো! এবার জেগে ওঠো! এবার জেগে ওঠো…

লেখক: উদ্যোক্তা ও সংগঠক

(প্রথম প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি, ২০২১/দৈনিক মতপ্রকাশ)

এবার জেগে ওঠো, বন্ধু!

প্রকাশের সময়: ০৪:০৭:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৪

ময়মনসিংহ: ১৯৭১ সালে মধ্যবিত্তদের নেতৃত্বে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অপরিসীম ত্যাগ এবং সাহসী লড়াইয়ের ফলশ্রুতিতেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে উচ্চবিত্তদের হাতে।

মিলিটারি শাসিত ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান রাষ্ট্র জিম্মি ছিলো উচ্চবিত্ত ২২ টি পরিবারের হাতে। সেই জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেতেই মধ্যবিত্ত বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণ মতান্তরে প্রজাশাসিত স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল।

অথচ, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ৫০ বছর বয়সী স্বাধীন বাংলাদেশ পুনরায় কতিপয় উচ্চবিত্তের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে; পাকিস্তানের ২২ পরিবারের জায়গায় বড়জোড় স্বাধীন বাংলাদেশের ২২০ পরিবার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে মাত্র।

রাষ্ট্র পরিচালনায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ কেবল ৫ বছর পর পর ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় কতিপয় উচ্চবিত্ত প্রতিনিধি নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ কেমন স্বাধীনতা? এ কেমন মুক্তি? নিম্নবিত্তরা তো আজও কামলা দিয়েই খায়! মধ্যবিত্তের হাঁড়িতে তো আজও অনটন লেগেই আছে! কৃষক-শ্রমিক তো আজও ক্রমাগত নিষ্পেষিত হচ্ছে! বেকারত্ব-হতাশায় নিমজ্জিত কোটি কোটি তরুণ! উচ্চবিত্তের চাপিয়ে দেয়া “নিপীড়নমূলক অর্থনীতি” আজও দুঃখী বাঙালির রক্ত চুষে নিচ্ছে!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা এখন উচ্চবিত্তের সার্কেলে বন্দী। নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের হাহাকার চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গণভবনের চারদিকে ঘিরে থাকা উচ্চবিত্তের দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করতে পারে না। শুধু শেখ হাসিনা কেন? স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সামরিক ক্যান্টনমেন্টে যে দুটি বৃহৎ দলের জন্ম হয়েছে, তাদেরও তো একই অবস্থা! কিংবা অন্য যেকোনো রাজনৈতিক দল -সবখানেই তো উচ্চবিত্তের আস্ফালন! বারিধারার অভিজাত প্রেসিডেন্ট পার্কে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কেন্দ্রে মানুষের স্থান কোথায়? লন্ডনের বিলাসবহুল জীবনে বসে তারেক রহমান ঘটাবেন বাঙালি কৃষকের মুক্তি? মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারখেকো মোল্লারা তো স্বর্গের দিবাস্বপ্নেই বিভোর! ভিনদেশী অর্থায়নে সমাজতান্ত্রিক নেতারাও তো রাজধানীর ফ্ল্যাটে-ফ্ল্যাটে বিপ্লব করছেন!

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্য স্মরণকালের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। উচ্চবিত্তের প্রভাব এতটাই প্রকট হয়েছে যে, প্রত্যন্ত পল্লী গ্রামের একজন মেম্বারকেও ১৫-২০ লাখ টাকা খরচ করে নির্বাচিত হতে হয়, দেশের যেকোনো প্রান্তের একজন ইউপি চেয়ারম্যানের ন্যুনতম নির্বাচনী খরচ এক থেকে দেড় কোটি টাকায় উঠে গেছে, একজন এমপিকে অনায়াসে ৫-১০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়!

রাষ্ট্রকে উচ্চবিত্তের নিয়ন্ত্রণে নিতে দলীয় মনোনয়ন নামক তামাশার আবির্ভাব ঘটেছে। নির্বাচনের আগেই উচ্চবিত্তের টাকার কাছে মনোনয়ন বিক্রি হওয়ায় নিপীড়িত জনতার রায় উপেক্ষিত হচ্ছে। দেশের একদম রুট লেভেল থেকে রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ ঘটিয়ে উচ্চবিত্তের সিন্ডিকেট জিম্মি করে রেখেছে আপামর জনসাধারণকে।

এসব কারণে সরকারের কোনক্ষেত্রেই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোন অবস্থান নেই। চাকুরী করতে গেলে লেখাপড়ায় যে উচ্চখরচ কিংবা যে ঘুষ দিতে হয় -তা যোগানের সুযোগ সমাজের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষের নেই বিধায় সমস্ত ভাল ভাল চাকরির বাজারও ক্রমান্বয়ে উচ্চবিত্তের দখলে চলে যাচ্ছে। নিম্নবিত্তের সন্তানেরা-মধ্যবিত্তের সন্তানেরা বড়জোর গার্মেন্টস শ্রমিক, এনজিও কর্মী, ব্যাংকের ক্লার্ক কিংবা কেজি স্কুলের মাস্টারিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে। আর, এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ঘুরেফিরে সীমাবদ্ধ কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারের হাতেই।

কিন্তু, বন্ধু, এমন তো কথা ছিলো না! ১৯৭১ সালে দেশের গরীব ছেলে-মেয়েরা জীবন দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন তো এজন্য করে যাননি! ওরা শহরে বসে দামী বাড়িতে থাকবে, দামী গাড়িতে ঘুরবে, বিলাসী জীবন যাপন করবে আর দেশের মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হাঁস-ফাঁস করবে, বেকারত্বের অভিশাপে প্রজন্ম নিষ্পেষিত হবে, চিকিৎসার অভাবে নিরীহ মানুষ মরবে -এমন শর্তে তো একাত্তরের যুদ্ধটা করেননি!

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিক-বেকারের মুক্তির জন্য, নিম্নবিত্তের মুক্তির জন্য, মধ্যবিত্তের মুক্তির জন্য -প্রজন্মকে ভাবতে হবে। উচ্চবিত্ত রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের ঘুমপাড়ানি গানে ঘুমিয়ে না থেকে প্রবল বিক্রমে ঐক্যবদ্ধভাবে জেগে উঠতে হবে। সমস্ত শৃঙ্খল ভেঙে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য উচ্চবিত্তের কোষাগারে প্রবলভাবে আঘাত হানতে হবে। প্রত্যেক গ্রামে এই উচ্চবিত্ত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হবে।

একাত্তরের সাতই মার্চে জনকের সেই উদাত্ত আহবান -“এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”। সেই মুক্তির জন্য সংগ্রাম শেষ হয়নি, বন্ধু! সে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হও। নিজেদের তৈরি কর। মুক্তি আসন্ন।

আর ঘুমিয়ে থাকার সময় নেই, বন্ধু! এবার জেগে ওঠো! এবার জেগে ওঠো! এবার জেগে ওঠো…

লেখক: উদ্যোক্তা ও সংগঠক

(প্রথম প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি, ২০২১/দৈনিক মতপ্রকাশ)