ময়মনসিংহ ১০:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলায় আধুনিক সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শক ময়মনসিংহের কেদারনাথ মজুমদার

কেদারনাথ মজুমদার। ফাইল ছবি

[হাওড়-বাওড় আর মইষের শিং -এই নিয়ে ময়মনসিংহ। প্রিয় পাঠক, হাজার বছরের ইতিহাসে ময়মনসিংহের যেসব কৃতি সন্তান তাঁদের মেধা-মননশীলতা ও কর্মের মাধ্যমে এই মাটিকে গৌরবান্বিত করেছেন, ২০১৬-২০১৭ সালে একবিংশ শতকের নতুন প্রজন্মের কাছে সেইসব মনীষীর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল ময়মনসিংহ বিভাগভিত্তিক প্রথম ও একমাত্র অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘ময়মনসিংহ ডিভিশন টুয়েন্টিফোর ডটকম’। সেই ধারাবাহিকতার নবম পর্বে ছিল ময়মনসিংহের কৃতি সন্তান কেদারনাথ মজুমদারের জীবনী। প্রিয় পাঠক, আপনাদের সেই প্রিয় পোর্টালেরই বিবর্তিত প্ল্যাটফর্ম ‘প্রতিদিনের ময়মনসিংহ’ লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করল]

ময়মনসিংহ: বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক, বাংলার মাটিতে আধুনিক সাংবাদিকতার অন্যতম পথপ্রদর্শক কেদারনাথ মজুমদার বাংলা ১২৭৭ সালের ২৬ জ্যৈষ্ঠ (ইংরেজি ১৮৭০সাল) তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জের কাপাসাটিয়া গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে, তার নিজ বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার গচিহাটা গ্রামে। তার বাবার নাম লোকনাথ মজুমদার ও মায়ের নাম জয়দুর্গা দেবী।

তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ গ্রামেরই একটি স্কুলে। প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হওয়া মাত্র তাঁকে নিয়ে আসা হয় ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে তিনি “নাসিরাবাদ এন্ট্রাস” স্কুলে ভর্তি হন। এরপর ভর্তি হন ময়মনসিংহ সিটি স্কুলে। ময়মনসিংহ সিটি স্কুল ছেড়ে ১৮৮৪ সালে তিনি ভর্তি হন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনীতে। এ স্কুল থেকেই তিনি ১৮৮৯ সালে এন্ট্রাস পাশ করেন। এখানেই তিনি তার পড়ালেখা জীবনের ইতি টানেন।

ছোট থেকেই কেদারনাথ নিজ দেশ ও ভূমির ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে খুব সচেতন ও আগ্রহী ছিলেন। স্বভূমির প্রতি তাঁর ছিলো গভীর মমত্ববোধ। তার বাবা লোকনাথ মজুমদার ও মা জয়দুর্গা দেবী- উভয়ই ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। আর বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়েন। ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের শিক্ষক শ্রীনাথচন্দ্র তাকে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ জোগান। এছাড়া তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের ‘মনোরঞ্জিকা ক্লাব’ এ সাহিত্য চর্চা করতেন। নাসিরাবাদ স্কুলের হেড পণ্ডিত বেদজ্ঞ উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছ থেকে তিনি শাস্ত্র ও পুরাণনুশীলনে আগ্রহী হয়ে উঠেন।

কেদারনাথ মজুমদারের বাবা-মায়ের সামান্য কিছু সম্পত্তি ছিল, যা তিনি পরবর্তীতে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। তাই সংসার চালানোর জন্য তিনি সামান্য বেতনে ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের ফৌজদারি থানায় নকলনবিশের চাকরি নেন। তবে, তিনি যে পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তা দিয়ে চাকরি পাওয়া খুব সহজ ছিল না। তাই, তাঁর মামা কৃষ্ণকুমার রায় তাঁকে এ চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। চাকরিতে যে বেতন পেতেন তা দিয়ে সংসার চালানোই ছিল দায়। আর, এ চাকরির উপর নির্ভর করেই তিনি সাহিত্য চর্চাও করতেন। তাই তিনি সাহিত্য চর্চার খরচ যোগানের জন্য চাকরির পাশাপাশি পাঠ্য বই প্রণয়ন, ছাপাখানা পরিচালনা ও মানচিত্র প্রকাশ ইত্যাদি কাজ শুরু করেন। চাকরি জীবনে তিনি একসময় খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এজন্য তিনি ১৯০১ সালে চাকরি ছেড়ে দেন।

কেদারনাথ মজুমদারের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় স্কুলে পড়া অবস্থা থেকেই। স্কুলে পড়ার সময় তিনি রচনা করেন তার প্রথম উপন্যাস ‘স্রোতের ফুল’। তিনি স্কুল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রচনা করেন ‘ঢাকা সহচর (১৯০৮-২য় সংস্করণ)’, “ময়মনসিংহ সহচর (১৯০৮)”, “বাংলা সহচর”, “আদর্শ গণিত ও সচিত্র ভূগোল”।

চাকরি করলেও কেদারনাথ মজুমদারের সাহিত্যকর্ম ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণা থেমে থাকেনি। বিভিন্ন নামকরা পত্র-পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হত অহরহ। চাকরি অবস্থাতেই তিনি সম্পাদনা করেন ‘সাময়িকপত্র’। বাংলা ১২৯৫ সালের বৈশাখ মাস থেকে তিনি ‘কুমার’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। যেটি প্রকাশ হয়েছিলো বাংলা ১২৯৫ সালের বৈশাখ সংখ্যা থেকে শ্রাবণ সংখ্যা পর্যন্ত। কুমার পত্রিকা বন্ধ হলে তিনি চালু করেন ‘বাসনা’ নামে আরেকটি পত্রিকা। এরপর তিনি ‘আরতি’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলা ১৩১৯ সালের কার্তিক মাসে তিনি ‘সৌরভ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর আগে তিনি ‘সম্মিলন’ নামে একটি পত্রিকার পরিচালক নিযুক্ত হন। যার জন্য তিনি কিছুদিন ঢাকায় বসবাস করেন।

সৌরভ’ পত্রিকাটি প্রথমে পুস্তাকারে প্রকাশ হত, পরবর্তীতে তিনি এটাকে ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশ করেন। ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি ময়মনসিংহে নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রিসার্চ হাউস’ এবং পত্রিকা প্রকাশের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘সৌরভ প্রেস’। তার প্রতিষ্ঠিত সৌরভ পত্রিকাটি ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রাণ স্বরূপ। সেখানে লিখতেন পবিত্র কোরআন শরীফের বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, স্বভাব কবি গোবিন্দ দাস, চন্দ্রকুমার দে ও সৌরভ কুমার রায় –সহ অনেক নামকরা কবি-সাহিত্যিকগণ। তবে ‘সৌরভ’ পত্রিকাটি ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের পর বন্ধ হয়ে যায়।

কেদারনাথ মজুমদার এক সময় সাহিত্যের মধ্যমণি হিসেবে পরিণত হন। স্থানীয় কবি ও লেখকদের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সৌরভ সংঘ’। ১৩১৮ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাহিত্য পরিষদ’। এরপর তিনি ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’ নামে একটি আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯০৪ সালে প্রকাশ করেন ‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ এবং এ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন ১৯০৭ সালে। ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’ ও ‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ রচনা করে তিনি একজন নামকরা ইতিহাসবিদের খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ‘ময়মনসিংহের কাহিনী’ ও ‘ময়মনসিংহ পল্লী বিবরণ‘ নামে দুটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এ দুটি বইয়ের কোন হদিস এখনও পাওয়া যায়নি।

নিজ জেলার বাইরেও তিনি ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। ১৯১০ সালে তিনি রচনা করেন ‘ঢাকার বিবরণ’ এছাড়া তিনি ‘ফরিদপুরের বিবরণ’ নামে একটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তবে ‘ফরিদপুরের বিবরণ’ নামের ইতিহাস গ্রন্থটির কোন সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। বাংলা ১৩১৫ সালে রচনা করেন ‘সারস্বত কুঞ্জ’ নামে একটি গবেষণা গ্রন্থ। ১৯১৭ সালে রচনা করেন বাঙলা ‘সাময়িক সাহিত্য’ গ্রন্থটি। পরবর্তীতে অনেক গবেষক এ বইটিকে গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছিলেন।

কেদারনাথ মজুমদার জীবনে চারটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ১৮৮৮ সালে যে ‘স্রোতের ফুল’ উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন, পরবর্তীতে সেটির নাম পরিবর্তন করে ‘প্রফুল্ল’ নামে প্রকাশ করেন। ‘স্রোতের ফুল’ উপন্যাসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ১৮৭৭ সালের নোয়াখালী জেলার প্লাবনের (বন্যার) করুন কাহিনী। বাংলা ১৩৩০ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘শুভদৃষ্টি’ উপন্যাস এবং ১৩৩১ সালে প্রকাশ করেন ‘সমস্যা’ উপন্যাস। তিনি ‘দস্যুর মহত্ত্ব’ ‘স্বপ্ন’ ও ‘ঋণ পরিশোধ’ নামে তিনটি ক্ষুদ্র উপন্যাস লিখিছিলেন। এ তিনটি উপন্যাসকে সমষ্টি করে ১৯০৬ সালে জুলাই মাসে প্রকাশ করেন ‘চিত্র’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস।

বাংলা ১৩১০ সাল থেকে কেদারনাথ মজুমদার সনাতন (হিন্দু) ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ ‘রামায়ণ’ মহাকাব্যকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তবে, সে সময় রামায়ণ নিয়ে গবেষণা করা ছিল খুবই কঠিন কাজ। তিনি ‘রামায়ণ’ কে একটি ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক গ্রন্থ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। রামায়ণের উপর গবেষনা স্বরূপ তিনি ‘রামায়ণ সমাজ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যে বইটি তার মৃত্যুর দুই বছর পর প্রকাশ হয়েছিলো। ‘রামায়ণ সমাজ’ গ্রন্থটি রচনা করার সময়ই তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং অসুস্থ অবস্থায়ই ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৬ই জ্যৈষ্ঠ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র: বাংলাকোষ

বাংলায় আধুনিক সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শক ময়মনসিংহের কেদারনাথ মজুমদার

প্রকাশের সময়: ০২:১২:৫৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৪

[হাওড়-বাওড় আর মইষের শিং -এই নিয়ে ময়মনসিংহ। প্রিয় পাঠক, হাজার বছরের ইতিহাসে ময়মনসিংহের যেসব কৃতি সন্তান তাঁদের মেধা-মননশীলতা ও কর্মের মাধ্যমে এই মাটিকে গৌরবান্বিত করেছেন, ২০১৬-২০১৭ সালে একবিংশ শতকের নতুন প্রজন্মের কাছে সেইসব মনীষীর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল ময়মনসিংহ বিভাগভিত্তিক প্রথম ও একমাত্র অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘ময়মনসিংহ ডিভিশন টুয়েন্টিফোর ডটকম’। সেই ধারাবাহিকতার নবম পর্বে ছিল ময়মনসিংহের কৃতি সন্তান কেদারনাথ মজুমদারের জীবনী। প্রিয় পাঠক, আপনাদের সেই প্রিয় পোর্টালেরই বিবর্তিত প্ল্যাটফর্ম ‘প্রতিদিনের ময়মনসিংহ’ লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করল]

ময়মনসিংহ: বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক, বাংলার মাটিতে আধুনিক সাংবাদিকতার অন্যতম পথপ্রদর্শক কেদারনাথ মজুমদার বাংলা ১২৭৭ সালের ২৬ জ্যৈষ্ঠ (ইংরেজি ১৮৭০সাল) তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জের কাপাসাটিয়া গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে, তার নিজ বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার গচিহাটা গ্রামে। তার বাবার নাম লোকনাথ মজুমদার ও মায়ের নাম জয়দুর্গা দেবী।

তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ গ্রামেরই একটি স্কুলে। প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হওয়া মাত্র তাঁকে নিয়ে আসা হয় ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে তিনি “নাসিরাবাদ এন্ট্রাস” স্কুলে ভর্তি হন। এরপর ভর্তি হন ময়মনসিংহ সিটি স্কুলে। ময়মনসিংহ সিটি স্কুল ছেড়ে ১৮৮৪ সালে তিনি ভর্তি হন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনীতে। এ স্কুল থেকেই তিনি ১৮৮৯ সালে এন্ট্রাস পাশ করেন। এখানেই তিনি তার পড়ালেখা জীবনের ইতি টানেন।

ছোট থেকেই কেদারনাথ নিজ দেশ ও ভূমির ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে খুব সচেতন ও আগ্রহী ছিলেন। স্বভূমির প্রতি তাঁর ছিলো গভীর মমত্ববোধ। তার বাবা লোকনাথ মজুমদার ও মা জয়দুর্গা দেবী- উভয়ই ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। আর বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়েন। ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের শিক্ষক শ্রীনাথচন্দ্র তাকে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ জোগান। এছাড়া তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের ‘মনোরঞ্জিকা ক্লাব’ এ সাহিত্য চর্চা করতেন। নাসিরাবাদ স্কুলের হেড পণ্ডিত বেদজ্ঞ উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছ থেকে তিনি শাস্ত্র ও পুরাণনুশীলনে আগ্রহী হয়ে উঠেন।

কেদারনাথ মজুমদারের বাবা-মায়ের সামান্য কিছু সম্পত্তি ছিল, যা তিনি পরবর্তীতে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। তাই সংসার চালানোর জন্য তিনি সামান্য বেতনে ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের ফৌজদারি থানায় নকলনবিশের চাকরি নেন। তবে, তিনি যে পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তা দিয়ে চাকরি পাওয়া খুব সহজ ছিল না। তাই, তাঁর মামা কৃষ্ণকুমার রায় তাঁকে এ চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। চাকরিতে যে বেতন পেতেন তা দিয়ে সংসার চালানোই ছিল দায়। আর, এ চাকরির উপর নির্ভর করেই তিনি সাহিত্য চর্চাও করতেন। তাই তিনি সাহিত্য চর্চার খরচ যোগানের জন্য চাকরির পাশাপাশি পাঠ্য বই প্রণয়ন, ছাপাখানা পরিচালনা ও মানচিত্র প্রকাশ ইত্যাদি কাজ শুরু করেন। চাকরি জীবনে তিনি একসময় খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এজন্য তিনি ১৯০১ সালে চাকরি ছেড়ে দেন।

কেদারনাথ মজুমদারের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় স্কুলে পড়া অবস্থা থেকেই। স্কুলে পড়ার সময় তিনি রচনা করেন তার প্রথম উপন্যাস ‘স্রোতের ফুল’। তিনি স্কুল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রচনা করেন ‘ঢাকা সহচর (১৯০৮-২য় সংস্করণ)’, “ময়মনসিংহ সহচর (১৯০৮)”, “বাংলা সহচর”, “আদর্শ গণিত ও সচিত্র ভূগোল”।

চাকরি করলেও কেদারনাথ মজুমদারের সাহিত্যকর্ম ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণা থেমে থাকেনি। বিভিন্ন নামকরা পত্র-পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হত অহরহ। চাকরি অবস্থাতেই তিনি সম্পাদনা করেন ‘সাময়িকপত্র’। বাংলা ১২৯৫ সালের বৈশাখ মাস থেকে তিনি ‘কুমার’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। যেটি প্রকাশ হয়েছিলো বাংলা ১২৯৫ সালের বৈশাখ সংখ্যা থেকে শ্রাবণ সংখ্যা পর্যন্ত। কুমার পত্রিকা বন্ধ হলে তিনি চালু করেন ‘বাসনা’ নামে আরেকটি পত্রিকা। এরপর তিনি ‘আরতি’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলা ১৩১৯ সালের কার্তিক মাসে তিনি ‘সৌরভ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর আগে তিনি ‘সম্মিলন’ নামে একটি পত্রিকার পরিচালক নিযুক্ত হন। যার জন্য তিনি কিছুদিন ঢাকায় বসবাস করেন।

সৌরভ’ পত্রিকাটি প্রথমে পুস্তাকারে প্রকাশ হত, পরবর্তীতে তিনি এটাকে ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশ করেন। ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি ময়মনসিংহে নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রিসার্চ হাউস’ এবং পত্রিকা প্রকাশের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘সৌরভ প্রেস’। তার প্রতিষ্ঠিত সৌরভ পত্রিকাটি ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রাণ স্বরূপ। সেখানে লিখতেন পবিত্র কোরআন শরীফের বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, স্বভাব কবি গোবিন্দ দাস, চন্দ্রকুমার দে ও সৌরভ কুমার রায় –সহ অনেক নামকরা কবি-সাহিত্যিকগণ। তবে ‘সৌরভ’ পত্রিকাটি ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের পর বন্ধ হয়ে যায়।

কেদারনাথ মজুমদার এক সময় সাহিত্যের মধ্যমণি হিসেবে পরিণত হন। স্থানীয় কবি ও লেখকদের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সৌরভ সংঘ’। ১৩১৮ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাহিত্য পরিষদ’। এরপর তিনি ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’ নামে একটি আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯০৪ সালে প্রকাশ করেন ‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ এবং এ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন ১৯০৭ সালে। ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’ ও ‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ রচনা করে তিনি একজন নামকরা ইতিহাসবিদের খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ‘ময়মনসিংহের কাহিনী’ ও ‘ময়মনসিংহ পল্লী বিবরণ‘ নামে দুটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এ দুটি বইয়ের কোন হদিস এখনও পাওয়া যায়নি।

নিজ জেলার বাইরেও তিনি ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। ১৯১০ সালে তিনি রচনা করেন ‘ঢাকার বিবরণ’ এছাড়া তিনি ‘ফরিদপুরের বিবরণ’ নামে একটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তবে ‘ফরিদপুরের বিবরণ’ নামের ইতিহাস গ্রন্থটির কোন সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। বাংলা ১৩১৫ সালে রচনা করেন ‘সারস্বত কুঞ্জ’ নামে একটি গবেষণা গ্রন্থ। ১৯১৭ সালে রচনা করেন বাঙলা ‘সাময়িক সাহিত্য’ গ্রন্থটি। পরবর্তীতে অনেক গবেষক এ বইটিকে গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছিলেন।

কেদারনাথ মজুমদার জীবনে চারটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ১৮৮৮ সালে যে ‘স্রোতের ফুল’ উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন, পরবর্তীতে সেটির নাম পরিবর্তন করে ‘প্রফুল্ল’ নামে প্রকাশ করেন। ‘স্রোতের ফুল’ উপন্যাসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ১৮৭৭ সালের নোয়াখালী জেলার প্লাবনের (বন্যার) করুন কাহিনী। বাংলা ১৩৩০ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘শুভদৃষ্টি’ উপন্যাস এবং ১৩৩১ সালে প্রকাশ করেন ‘সমস্যা’ উপন্যাস। তিনি ‘দস্যুর মহত্ত্ব’ ‘স্বপ্ন’ ও ‘ঋণ পরিশোধ’ নামে তিনটি ক্ষুদ্র উপন্যাস লিখিছিলেন। এ তিনটি উপন্যাসকে সমষ্টি করে ১৯০৬ সালে জুলাই মাসে প্রকাশ করেন ‘চিত্র’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস।

বাংলা ১৩১০ সাল থেকে কেদারনাথ মজুমদার সনাতন (হিন্দু) ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ ‘রামায়ণ’ মহাকাব্যকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তবে, সে সময় রামায়ণ নিয়ে গবেষণা করা ছিল খুবই কঠিন কাজ। তিনি ‘রামায়ণ’ কে একটি ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক গ্রন্থ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। রামায়ণের উপর গবেষনা স্বরূপ তিনি ‘রামায়ণ সমাজ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যে বইটি তার মৃত্যুর দুই বছর পর প্রকাশ হয়েছিলো। ‘রামায়ণ সমাজ’ গ্রন্থটি রচনা করার সময়ই তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং অসুস্থ অবস্থায়ই ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৬ই জ্যৈষ্ঠ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র: বাংলাকোষ