ময়মনসিংহ: হাজার হাজার মানুষের সুশৃঙ্খল অংশগ্রহণে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ায় অনুষ্ঠিত হলো হুমগুটি খেলার ২৬৫ তম আসর। রোববার (১৪ জানুয়ারি) হুমগুটি খেলার শুভ উদ্বোধন করেন নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আব্দুল মালেক সরকার।
খেলাটি ঘিরে চারদিকে ছিল উৎসবের আমেজ। ঐতিহ্যবাহী খেলাটি উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও আসেন উৎসাহী লোকজন। খেলা উপলক্ষে স্বামীর বাড়ি থেকে স্বামী ও তার পরিবারসহ বাপের বাড়ি নাইওর আসেন এলাকার বিবাহিত মেয়েরা। তাদের জন্য বাড়িতে চলে পিঠা ও পায়েস-পুলির উৎসব।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও পৌষ মাসের শেষ দিনে উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ই আটা এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এই হুমগুটি খেলা। খেলা শুরুর আগেই খেলাস্থলের মাঠ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। ৪০ কেজি ওজনের পিতলের তৈরি বলের মতো দেখতে একটি গুটি নিয়ে টানাটানিই হলো এ খেলার আসল সৌন্দর্য।
প্রথমে এলাকাভিত্তিক আলাদা আলাদা দলে শত শত খেলোয়াড়ের অংশগ্রহণে চলে গুটি দখলের শক্তিমত্তার তীব্র লড়াই। হুড়োহুড়ি টানাটানি কাড়াকাড়ি করে যে বা যারা এই গুটিটি গুম করে ফেলতে পারবে তারাই হয় বিজয়ী দল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দরকার না হলেও সুশৃখলভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে রেফারি বিহিন এই খেলা।
এদিকে হুমগুটি খেলাকে ঘিরে বসেছিল গ্রামীণ মেলা। মেলায় শিশুদের খেলনা ও খাবারের দোকানেও ছিল উপচেপড়া ভিড়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খেলা দেখতে সপরিবারে আসে অনেকেই।
উল্লেখ্য, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় লক্ষ্মীপুরের বড়ই আটায় তালুক-পরগনার সীমানায় অনুষ্ঠিত একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা। ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের জমি পরিমাপের বিরোধের মীমাংসা করতে আয়োজন হয়েছিল এই খেলার। পরবর্তীতে আমন ধান কাটা শেষ, বোরো ধান আবাদের আগে প্রজাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য জমিদারদের এই পাতানো খেলা চলছে আড়াইশো বছরের অধিক সময় ধরে।
হুমগুটি হচ্ছে একটি পিতলের তৈরি ৪০ কেজির গোলাকার বল। এ বল নিয়ে মাঠে লাখো মানুষের কাড়াকাড়ি হয় এর দখল নিয়ে। সবার মুখে উচ্চারিত হয় “জিতই আবা দিয়া গুটি ধররে হেইও…।
সাধারণত ফাল্গুনে আমন ধান ও তৎপরবর্তী রবিশস্য তোলার পর চৈত্রের শেষে অথবা প্রথমে ফসলবিহীন দিগন্ত বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তরে এ খেলা জমে উঠে। প্রধানত গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া কৃষাণ পরিবার সুস্থ্, সবল, সাহসী যুবক থেকে শুরু করে প্রাক প্রবীণ বয়সীরাই এ খেলায় অংশগ্রহন করে। খেলায় থাকে একটি মাত্র অদ্ভুদ উপকরণ। বৃহদাকার পিতলের কলসির গলার নিচের গোলাকার যে অংশ ঠিক সে রকমের একটি অংশের ভিতরে এমনভাবে মাটি ঠেসে ভরা হয় যে, মুখ বন্ধের পর তাতে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েও মাটি বের করা যায় না। এটি দলগত খেলা।
২৫০ বছর আগে মুক্তাগাছার রাজা শশীকান্ত আচার্য্যের সঙ্গে ত্রিশালের বৈলরের জমিদার হেমচন্দ্র রায়ের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। তখনকার দিনে তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে, পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের জমিতে দুই নীতির কারণে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই বিরোধ মীমাংসা করার জন্য লক্ষীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে ‘তালুক-পরগনার সীমানায়’ এই গুটি খেলার আয়োজন শুরু করা হয়। গুটি খেলার শর্ত ছিল গুটি গুমকারী এলাকাকে ‘তালুক’ এবং পরাজিত অংশের নাম হবে ‘পরগনা’। মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয় জমিদার আমলের সেই গুটি খেলায়।
স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মোড়ল পরিবার বর্তমানে ধারাবাহিকভাবে এই খেলার আয়োজন করে আসছে।
পৌষ মাসের শেষদিন কে এ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় পুহুরা। এই দিনেই যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই খেলা। বিকেল তিনটায় শুরু হয় এই খেলা। খেলা চলে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত।