নিহার আর নায়েক: ভারতীয় রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর আমন্ত্রণে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ডঃ মোহাম্মদ মুইজু ৬ থেকে ১০ অক্টোবর ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে আসেন।
মালদ্বীপ থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সাথে এই সফরটি ছিল প্রেসিডেন্ট মুইজুর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর, যেখানে তিনি জুন ২০২৪-এ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়াও, তারা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ-২৮ শীর্ষ সম্মেলনে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
এই সফরে ডঃ মুইজু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ এস. জয়শঙ্কর এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
সফরের গুরুত্ব
উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক বিনিময় দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কের প্রতি ভারতের গুরুত্বের প্রমাণ ডঃ মুইজুর ভারত সফর, যা ডঃ জয়শঙ্করের মালদ্বীপ সফরের পরপরই ঘটে।
এই সফর এমন সময়ে ঘটেছে যখন দ্বীপ দেশটি ঋণখেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে, এবং এর বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে ৪৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা প্রায় দেড় মাসের আমদানির খরচ কভার করতে পারে।
মুডিজের ক্রেডিট রেটিং কমানোর পরে, ঋণখেলাপির ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ডঃ মুইজু চীন সফরকালে কোনো আর্থিক সহায়তা না পাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
এছাড়া, মালদ্বীপের পর্যটন-নির্ভর অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারণ গত বছর ভারতীয় পর্যটকদের সংখ্যা ৫০,০০০ কমেছে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের ফল।
এই হ্রাসের ফলে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সম্প্রতি ভারত সফর এই প্রবাহ পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা বাড়িয়েছে।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি
মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও চাপ তৈরি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মুইজু এবং তার জোট সহযোগী আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। ইয়ামিন, যিনি অর্থপাচারের অভিযোগে কারাবন্দী ছিলেন, নির্বাচনের পর তাকে মুক্তি দেওয়ার প্রত্যাশা ছিল।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট মুইজু এই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি, যার ফলে ইয়ামিন, যিনি বর্তমানে গৃহবন্দী, প্রেসিডেন্ট মুইজুর থেকে দূরত্ব তৈরি করে নিজের রাজনৈতিক দল, পিপলস ন্যাশনাল ফ্রন্ট, গঠন করেছেন।
ভারতের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি
ভারতের দৃষ্টিতে মালদ্বীপের গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষ করে ভারতের ‘সাগর’ উদ্যোগ এবং ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির আওতায়।
ভারত মহাসাগর অঞ্চলে (আইওআর) মালদ্বীপের অবস্থান এবং এর সামুদ্রিক ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মালদ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সামুদ্রিক কার্যক্রম ভারতীয় কৌশলগত ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে।
এই কারণে, ভারতের জন্য মালদ্বীপের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা ও উন্নত করা অপরিহার্য। ভারতের কোনো প্রতিশ্রুতির অভাব বা কমতি পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে এমন বহির্বিশ্বের শক্তিকে আকর্ষণ করতে পারে, যা ভারতের স্বার্থের জন্য হানিকর হতে পারে।
আর্থিক সহায়তা
প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের বৈঠকের পরে, ভারত একটি যৌথ বিবৃতি জারি করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী এই সফরকে “সম্পর্কের নতুন অধ্যায়” বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে মালদ্বীপের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য ভারত সবসময় পাশে থাকবে।
ভারত মালদ্বীপকে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৩০ বিলিয়ন রুপি মূল্যের মুদ্রা বিনিময় চুক্তি সহায়তা প্রদান করেছে। এই পদক্ষেপগুলো মালদ্বীপের আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে। আগেও ভারত, এসবিআই-এর মাধ্যমে প্রদত্ত ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার টিবিল পুনর্গঠনের মাধ্যমে মালদ্বীপকে আর্থিক সহায়তা করেছে, যা তাদের তাত্ক্ষণিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে সহায়ক ছিল।
উন্নয়ন সহযোগিতা
ভারত ১৯৯০ সাল থেকে মালদ্বীপের প্রধান উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বিভিন্ন কমিউনিটি উন্নয়ন এবং অবকাঠামো প্রকল্পে সহায়তা করছে।
ভারত মালদ্বীপের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং সর্ববৃহৎ বিনিয়োগকারী। ২০২০ সাল থেকে সরাসরি কার্গো জাহাজ পরিষেবা চালু রয়েছে এবং ২০২১ সালে লাইনে ক্রেডিট প্রকল্প চালুর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগিতা গভীরতর হয়েছে।
ভারতীয় ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার এবং শুল্কমুক্ত টুনা রপ্তানির চুক্তি বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছে।
ভারতের উন্নয়ন সহায়তা প্রধানত বড় এবং উচ্চ-প্রভাব প্রকল্পের মাধ্যমে প্রদান করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, রাস্তা এবং ভূমি পুনর্দখল প্রকল্প, স্টেডিয়াম, এবং সামাজিক গৃহায়ন উদ্যোগ।
ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক
আকার, সম্পদ এবং অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে পার্থক্য সত্ত্বেও, ভারত ও মালদ্বীপ পরস্পরের কৌশলগত মূল্য স্বীকার করে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে নিজেদের অবস্থান মজবুত করেছে।
১৯৮৮ সালের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা, ২০০৪ সালের সুনামি এবং ২০১৪ সালের পানি সংকটের সময় ভারতের দ্রুত প্রতিক্রিয়া সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাস গভীর করেছে।
মালদ্বীপও তার ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতি বজায় রেখেছে এবং ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে নিজের অবস্থানকে জোরালোভাবে পুনর্ব্যক্ত করেছে, বিশেষ করে ভারতের পশ্চিম উপকূলের কাছে তার কৌশলগত অবস্থানের প্রেক্ষাপটে।
নতুন উদ্যোগ ও সম্পর্কের উন্নতি
সাম্প্রতিক সময়ে, ডঃ মুইজু সরকারের অধীনে ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। তিনজন মালদ্বীপী কর্মকর্তার ভারতবিরোধী মন্তব্য এবং ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহারের নির্দেশনা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে জটিল করেছিল।
কিন্তু সম্প্রতি মালদ্বীপের সমন্বয়মূলক পদক্ষেপ এবং ভারতের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছে। প্রেসিডেন্ট মুইজু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং প্রকাশ্যে ভারতকে “মূল সহযোগী ও অমূল্য অংশীদার” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
পরিশেষ
সাম্প্রতিক সফরটি মালদ্বীপ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করেছে। অতীতের উত্তেজনা এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, এই সফর ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি এবং মালদ্বীপের সাথে কৌশলগত সম্পর্কের গুরুত্বকে পুনর্ব্যক্ত করেছে।
সফরের সময় হওয়া চুক্তিগুলো দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে এবং দীর্ঘমেয়াদী সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: এমপি-আইডিএসএ-এর রিসার্চ ফেলো; এই প্রবন্ধে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক