অ্যাম্বাসাডর অনিল ত্রিগুনায়াত: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১০-১১ অক্টোবর লাওস সফর করেন ২১তম আসিয়ান-ভারত সম্মেলন এবং ১৯তম পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য। এই সম্মেলনগুলো ভারতের দশকের পুরনো ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি এবং আসিয়ান দেশগুলির সাথে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক স্তরে বিস্তৃত কৌশলগত সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৯২ সাল থেকে ভারত ‘লুক ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করে এবং আসিয়ানের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সাথে ধাপে ধাপে সম্পর্ক গড়ে তুলতে থাকে। ২০১৪ সালে এই নীতিকে আরও কৌশলগত স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। এবারের সফরে দুইটি যৌথ বিবৃতি গৃহীত হয়, যার মধ্যে ছিল ডিজিটাল রূপান্তর এবং ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি, যা ভবিষ্যতে আসিয়ান-ভারত সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপন করবে।
এই কাঠামোটি ৪সি পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে, যা বাণিজ্য, সংযোগ, সংস্কৃতি এবং ধারাবাহিকতার উপর গুরুত্ব দেয়। বর্তমান বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে এবং ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা অনুমান করা কঠিন, তাই সংযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
১০ দফা পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত-আসিয়ান সম্পর্কের সমৃদ্ধি
আসিয়ান-ভারত সম্মেলনের মূল থিম ছিল “সংযোগ এবং স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি।” এই থিমকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী মোদী একটি ১০ দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল:
১. ২০২৫ সালকে আসিয়ান-ভারত পর্যটন বর্ষ হিসেবে উদযাপন করতে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ;
২. অ্যাক্ট ইস্ট নীতির দশক পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন যুব সম্মেলন, স্টার্টআপ উৎসব, হ্যাকাথন, সঙ্গীত উৎসব, আসিয়ান-ভারত থিংক ট্যাঙ্ক নেটওয়ার্ক এবং দিল্লি ডায়ালগ আয়োজন;
৩. নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তির সংখ্যা দ্বিগুণ করা এবং আসিয়ানের শিক্ষার্থীদের জন্য ভারতের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বৃত্তি প্রদান;
৪. ভারত-আসিয়ান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তহবিলের অধীনে নারীদের জন্য বিজ্ঞান সম্মেলন আয়োজন;
৫. ২০২৫ সালের মধ্যে আসিয়ান-ভারত বাণিজ্য চুক্তির দ্রুত পুনঃমূল্যায়ন এবং চূড়ান্তকরণ;
৬. ভারত-আসিয়ান তহবিল থেকে দুর্যোগ প্রতিরোধের জন্য ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ;
৭. স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রীদের বৈঠকের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ;
৮. ডিজিটাল এবং সাইবার নীতি সংলাপ;
৯. সবুজ ভবিষ্যতের লক্ষ্যে নিয়মিত কর্মশালা এবং তথ্য ও দক্ষতার বিনিময়;
১০. জলবায়ু প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য “এক পেড মা কে নাম” (মায়ের নামে একটি গাছ লাগান) উদ্যোগ।
অন্তর্ভুক্তিমূলক কিন্তু নিয়ম-ভিত্তিক ইন্দো-প্যাসিফিক
ভারত সবসময়ই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কিন্তু নিয়ম-ভিত্তিক ইন্দো-প্যাসিফিকের সমর্থন করেছে যেখানে বৈশ্বিক সম্পদ এবং সাধারণ সুবিধা বিশ্ব কল্যাণের জন্য প্রয়োজন। আধিপত্যবাদী মনোভাব বর্জন করা উচিত। ভারত আসিয়ানের ঐক্য এবং কেন্দ্রীয় ভূমিকার প্রতি সমর্থন দিয়েছে।
আসিয়ান ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং কোয়াড সহযোগিতার একটি মূল অংশ। ভারতের "ইন্দো-প্যাসিফিক ওশিয়ানস ইনিশিয়েটিভ" এবং আসিয়ানের "ইন্দো-প্যাসিফিক সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি"র মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্য রয়েছে।
একটি মুক্ত, উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমৃদ্ধ এবং নিয়ম-ভিত্তিক ইন্দো-প্যাসিফিক সমগ্র অঞ্চলের শান্তি ও অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ চীন সাগরের শান্তি, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা সমগ্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্বার্থে। প্রধানমন্ত্রী মোদী পুনর্ব্যক্ত করেছেন, “আমরা বিশ্বাস করি যে সামুদ্রিক কার্যক্রমগুলো ইউএনক্লস-এর অধীনে পরিচালিত হওয়া উচিত।
নেভিগেশন এবং আকাশসীমার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। একটি দৃঢ় এবং কার্যকর আচরণবিধি তৈরি করা উচিত, যা আঞ্চলিক দেশগুলির বৈদেশিক নীতির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করবে না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্প্রসারণবাদ নয়, বরং উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত।”
শান্তির জন্য সংলাপ ও কূটনীতি
বিশ্ব বর্তমানে ইউরেশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের চলমান যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবের সম্মুখীন, যা ডিসপ্রপোর্শনেটলি গ্লোবাল সাউথকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই প্রেক্ষাপটে শান্তির প্রয়োজনীয়তা, সংলাপ ও কূটনীতির ওপর পুনরায় গুরুত্বারোপ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদী উল্লেখ করেন, “এটি যুদ্ধের যুগ নয়। শান্তি, না যে যুদ্ধ, বুদ্ধের ভূমি থেকে আমাদের অগ্রাধিকার।”
ডিজিটাল রূপান্তরের অগ্রগতি
ভারতের ডিজিটাল জনসাধারণের পণ্য এবং পরিকাঠামোর ব্যবহারের ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যগুলি উল্লেখযোগ্য এবং এটি যৌথ বিবৃতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। এগুলো ডিজিটাল রূপান্তরকে অনুঘটক করতে, অন্তর্ভুক্তি, দক্ষতা, এবং উদ্ভাবনকে উন্নীত করতে ভূমিকা রাখবে।
একটি আসিয়ান-ভারত ডিজিটাল ফিউচার ফান্ড যৌথ কার্যক্রম সমর্থনের জন্য চালু করা হয়েছে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক
প্রধানমন্ত্রী মোদী আসিয়ান সম্মেলনের ফাঁকে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, এবং অন্যান্য আসিয়ান দেশগুলোর নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন। এটি ছিল তাঁর নতুন নেতৃত্বের সাথে প্রথম বৈঠক। তিনি লাওসের রাষ্ট্রপতিকে সন্মান প্রদর্শন করেছেন।
ভারত-লাওস সহযোগিতা ঐতিহাসিক এবং সভ্যতাগত সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে এবং নতুন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক বিনিময় হয়েছে। বিশেষ করে লাওসের বন্যা পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রদত্ত ত্রাণ সহযোগিতার জন্য প্রধানমন্ত্রী সিপান্ডোনে ধন্যবাদ জানান।
পরিশেষ
ভারত-আসিয়ান বাণিজ্য বর্তমানে ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, এবং আসিয়ান গোষ্ঠী হিসেবে আমেরিকার পর ভারতীয় বাণিজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার। তবে এই বাণিজ্য কাঠামোটি কিছুটা অসম, যা সংশোধিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং পরিষেবা খাতে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী সিঙ্গাপুরকে ধন্যবাদ জানান এবং ফিলিপাইনকে পরবর্তী সমন্বয়কারী হিসেবে স্বাগত জানান। তিনি এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, এটি হবে এশিয়ার শতাব্দী, এবং আসিয়ান-ভারতের কৌশলগত অংশীদারত্ব সেই শতাব্দীর নির্মাণে প্রধান ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের বিশিষ্ট ফেলো; তিনি জর্ডান, লিবিয়া, এবং মাল্টায় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন; এখানে প্রকাশিত মতামত তাঁর নিজের। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সাইফুল আলম তুহিন
ইমেইল: news@pratidinermymensingh.com
©সর্বস্বত্ব ২০১৬-২০২৪ | প্রতিদিনের ময়মনসিংহ