প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর তিন দিনের মার্কিন সফরের অংশ হিসেবে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে ১৫,০০০-এরও বেশি ভারতীয় সম্প্রদায়ের মানুষের সামনে ভাষণ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে অদ্বিতীয় উচ্ছ্বাসের সঙ্গে স্বাগত জানানো হয়, যেখানে তিনি ভারতীয়-আমেরিকান সম্প্রদায়ের ভূমিকা উল্লেখ করেন, যা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করছে।
মোদী তাঁর ভাষণে বিশ্বের দুই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের দীর্ঘদিনের অংশীদারিত্বের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ভারতীয় প্রবাসীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু হিসেবে কাজ করছে, যা সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে একদিন আগের গ্রিনভিল, ডেলাওয়্যারের বৈঠকের উল্লেখ করে বলেন, ভারতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী ভিত্তি এখন দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসের সেতু।
মোদীর সফরের প্রথম দিনে, একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ২৯৭টি ভারতীয় পুরাকীর্তি ফেরত দেয়, যা উন্নয়ন (বিকাশ) এবং ঐতিহ্য রক্ষার (বিরাসত) প্রতি দুই দেশের প্রতিশ্রুতি জোরদার করেছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাষণের অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল ২০৪৭ সালের মধ্যে “বিকশিত ভারত” (উন্নত ভারত) গড়ার তাঁর স্বপ্ন। তিনি তাঁর তৃতীয়বারের জন্য পুনঃনির্বাচনকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে উল্লেখ করেন এবং জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন যে তাঁর সরকার ভারতকে এক অনন্য উন্নয়নের যুগে নিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গত দশকের সাফল্য নিয়ে তিনি বলেন, “ভারত ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে, নতুন প্রজন্মের অবকাঠামো তৈরি করেছে এবং ১০তম বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে ৫ম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এখন আমাদের লক্ষ্য বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া।” তিনি সরকারের বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপের প্রশংসা করেন, যা ভারতের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে।
অর্থনৈতিক সংস্কার, ডিজিটাল প্রবৃদ্ধি ও নারী নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাষণ ছিল ভবিষ্যত-দর্শী, যেখানে তিনি ভারতের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি উদ্ভাবন, ডিজিটাল ক্ষমতায়ন, উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশটির নতুন এনার্জির কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর মতে, এই উদ্যম ভারতের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে বিকাশ করছে, যা প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে দেশকে শীর্ষস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি নারীদের নেতৃত্বে হওয়া পরিবর্তনের গুরুত্বও তুলে ধরেন, যা ভারতের সামগ্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ভারতের প্রচেষ্টার কথাও উল্লেখ করেন এবং নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
মোদী গর্বের সঙ্গে বলেন, “আজ ভারত বিশ্বে প্রবৃদ্ধি, সমৃদ্ধি, শান্তি ও নিরাপত্তার প্রধান অবদানকারী। উদ্ভাবন, জলবায়ু কর্মসূচি কিংবা বৈশ্বিক দক্ষতার ঘাটতি পূরণে, বিশ্বের মঞ্চে ভারতের কণ্ঠ আজ অনেক বেশি জোরালো।” তিনি আন্তর্জাতিক সরবরাহ এবং মূল্য চেইনে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরেন।
তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বোস্টন এবং লস এঞ্জেলসে দুটি নতুন ভারতীয় কনস্যুলেট খোলার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। পাশাপাশি, হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে তামিল স্টাডিজের জন্য থিরুভাল্লুভার চেয়ার স্থাপনের কথাও জানান, যা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।
মোদীর মার্কিন সফরের গুরুত্বপূর্ণ দিক মোদীর এই সফর তাঁর তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম সফর হিসেবে চিহ্নিত। তাঁর এই সফরটি ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে, যেখানে কোয়াড নেতাদের সম্মেলন এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও, তিনি জাতিসংঘের ‘সমিট অব দ্য ফিউচার’ এ মূল বক্তৃতা দেবেন, যেখানে তিনি বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা সংস্কার, জলবায়ু কর্মসূচি এবং টেকসই উন্নয়নের বিষয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করবেন।
মার্কিন প্রযুক্তি শিল্প নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী মোদী, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), সাইবার নিরাপত্তা এবং পরিচ্ছন্ন শক্তির মতো ক্ষেত্রগুলিতে ভারত-মার্কিন সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরা হবে।
ভারত ও প্রবাসীদের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক মোদীর মার্কিন সফরের অন্যতম প্রধান দিক ছিল ভারতীয় প্রবাসীদের সঙ্গে সংযোগ। ভারতীয়-আমেরিকান সম্প্রদায়কে ভারতীয় ‘নরম শক্তি’-র গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। তাঁদের অর্জনের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী প্রবাসীদের ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নে আরও অবদান রাখার আহ্বান জানান।
এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। মোদীর এই সফরের মাধ্যমে কোয়াড নেতাদের সম্মেলন এবং জাতিসংঘের সমাবেশে অংশগ্রহণ, দ্বিপাক্ষিক বৈঠক এবং মার্কিন প্রযুক্তি শিল্পের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা করা হয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নতুন কনস্যুলেট স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার অঙ্গীকার করেছেন। এছাড়াও, ভারতের প্রবাসীরা ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ‘জীবন্ত সেতু’ হিসেবে কাজ করছে বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
এই সফরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে অংশীদারিত্বের আরও প্রসার ঘটবে এবং বিশ্ব মঞ্চে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব আরও সুসংহত হবে। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক