রঞ্জিত কুমার: সেমিকন্ডাক্টর আধুনিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং শিল্পায়নের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে ভারতের লক্ষ্য পূরণের জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খল প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।
এই দশকের শেষে ভারতকে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকার একটি বিস্তৃত কৌশল গ্রহণ করেছে, যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সক্রিয় সমর্থনে পরিচালিত হচ্ছে। দেশীয় সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের সক্ষমতা গড়ে তোলা ভারতের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে উন্নত করবে এবং দেশকে উন্নত জাতির কাতারে স্থান দিতে সহায়ক হবে।
উদ্ভাবন ও স্বনির্ভরতার বিকাশ
এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ২০২১ সালে ভারত সেমিকন্ডাক্টর মিশন চালু করেছে, যা বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলিকে আকৃষ্ট করছে।
এ বছরের সেমিকন ইন্ডিয়া ২০২৪ উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়েছেন যে, ভারতের সেমিকন্ডাক্টর খাত একটি পরিবর্তনশীল বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, যেখানে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন শিল্পকে পুনর্গঠন করতে চলেছে।
"শেপিং দ্য সেমিকন্ডাক্টর ফিউচার" শীর্ষক এই বছরের থিম ভারতের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যা দেশকে সেমিকন্ডাক্টর নকশা, উৎপাদন এবং প্রযুক্তিগত বিকাশের ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তৈরি।
এই উদ্যোগ ভারতের বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর বাজারে অবস্থানকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি দেশীয় উদ্ভাবন ও স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যও পূরণ করছে।
দৃশ্যমানভাবে সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন পণ্যে, যেমন ইলেকট্রনিক্স, মোবাইল ডিভাইস, স্বয়ংচালিত প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, মহাকাশ প্রযুক্তি এবং পরমাণু সরঞ্জাম।
এই ধরনের অত্যাধুনিক এবং সংবেদনশীল শিল্পের অংশীদার হিসেবে ভারত জানে যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে দেশীয় সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খল গঠন অত্যাবশ্যক।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অনেক দেশ যারা প্রধানত চীন এবং তাইওয়ানের উপর নির্ভরশীল, তারা তাদের সেমিকন্ডাক্টর চাহিদার জন্য ভারতকে বিকল্প হিসেবে ভাবছে।
বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব
এই পরিবর্তনগুলি যে যৌথভাবে ভারতের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে তা নিশ্চিত। এই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হল এমন একটি ভাগ করা উপলব্ধি, যেখানে ভারত এবং অন্যান্য দেশগুলো বুঝতে পেরেছে যে, তাদের অর্থনীতিগুলি সরবরাহে বাধা বা চাপের সম্মুখীন হতে পারে।
ফলস্বরূপ, ভারতীয় নেতৃত্ব দেশীয় সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন এবং গবেষণা সক্ষমতা গড়ে তোলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যা দেশটির পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে সহায়ক হবে।
উপযোগী শিল্প পরিবেশ তৈরি
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ভারত বৈশ্বিক চিপ নির্মাতাদের আকৃষ্ট করতে অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং একটি অনুকূল শিল্প পরিবেশ তৈরি করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে, যা অত্যাধুনিক সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন কেন্দ্রগুলির জন্য অপরিহার্য।
ভারত সরকার আন্তর্জাতিক সেমিকন্ডাক্টর সংস্থাগুলিকে উৎসাহিত করার জন্য ৭৬ হাজার কোটি রুপি পরিমাণের একটি আর্থিক ভর্তুকির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। প্রাথমিকভাবে কিছু অনীহা থাকলেও, শীর্ষস্থানীয় সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিগুলি এখন ভারতে তাদের দ্বিতীয় উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এছাড়াও, সরকার তার কৌশলগত অংশীদারিত্বকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর এবং জাপানের সাথে, যার মাধ্যমে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণভাবে, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে গঠিত কোয়াড জোটও ভারতের সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছে।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিনিয়োগ কৌশল
সেমিকন ইন্ডিয়া ২০২৪-এর মাধ্যমে ভারতের অগ্রগতি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা উদ্ভাবন এবং স্বনির্ভরতার দিকে দেশের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করছে।
সরকারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতির ফলে, আগামী তিন থেকে চার বছরে সেমিকন্ডাক্টর প্রকল্পে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিনিয়োগ কৌশলের সফল বাস্তবায়ন ভারতের উৎপাদন খাতের রূপান্তর ঘটাবে।
এ পর্যন্ত, ভারত সরকার ২.৩৬ লক্ষ কোটি রুপিরও বেশি মূল্যের ছয়টি প্রধান বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, যা এই রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করবে।
এটি শুধুমাত্র ভারতকে সেমিকন্ডাক্টর খাতে নির্বাচিত কয়েকটি দেশের কাতারে স্থান দিচ্ছে না, বরং দেশটির দক্ষ শ্রমশক্তির জন্য নতুন সুযোগও সৃষ্টি করছে, যা সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে, বিশ্বব্যাপী সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইনের দক্ষ শ্রমশক্তির প্রায় ২০ শতাংশ ভারতের থেকে আসে, যা ভবিষ্যতে উৎপাদন এবং অ্যাসেম্বলি খাতে আরও দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে শক্ত ভিত্তি প্রদান করে।
উদীয়মান চাহিদা
বিশ্বব্যাপী দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি মেটাতে এসইএমআই, একটি বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্প সংস্থা, ভারতে একটি কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করেছে। এই শিল্পে আগামী কয়েক বছরে প্রায় ৩ লক্ষ দক্ষ পেশাদার প্রয়োজন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এআই বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই শিল্পকে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য প্রায় ১৫০টি নতুন ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্ট প্রয়োজন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেমিকন ২৪-এর মাধ্যমে সরকার এই বাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করার পরিকল্পনা করছে।
পরিশেষ
সেমিকন-ইন্ডিয়া ইভেন্টের সময় প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, ভারত ৮৫,০০০-এরও বেশি টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার এবং গবেষণা ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে, যারা সেমিকন্ডাক্টর এবং সম্পর্কিত শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
সরকার উন্নত এবং পরবর্তী প্রজন্মের চিপ তৈরি করতে ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাথে অংশীদারিত্বে একটি সেমিকন্ডাক্টর গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
সরকারের এই উদ্যোগ ভারতের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্ববাজারে চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই উদ্যোগটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কারণ ভারত, যেটি শিল্প বিপ্লবে সুযোগ হাতছাড়া করেছে, সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ ছাড়তে চায় না।
***লেখক একজন সিনিয়র সাংবাদিক এবং কৌশলগত বিষয়ক বিশ্লেষক; এখানে প্রকাশিত মতামত তার নিজস্ব। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সাইফুল আলম তুহিন
ইমেইল: news@pratidinermymensingh.com
©সর্বস্বত্ব ২০১৬-২০২৪ | প্রতিদিনের ময়মনসিংহ