ময়মনসিংহ ০৯:৫৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বেহাত টাঙ্গাইলের শাড়ি বনাম সংসদে ঐতিহ্যের হুমগুটি

অলংকরণ: প্রতিদিনের ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ: সম্প্রতি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়িকে নিজেদের ‘ভৌগোলিক নির্দেশক’ বা জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করে নিয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। এ নিয়ে দুইদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সচেতন মানুষের মাঝে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।

‘টাঙ্গাইলের শাড়ি’ নামের মাঝেই বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলাকে নির্দেশ করলেও ভারত পশ্চিমবঙ্গের নামে এর পেটেন্ট নিয়ে নেওয়ায় সারা পৃথিবীর মানুষ এখন থেকে জানবে এই উৎকৃষ্ট মানের শাড়ি ভারতের সম্পদ। ফলে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি বিশ্ববাজারে মূল্য হারাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাঁতশিল্প।

এটি এমন এক বিষয়, যেন জন্মদাতার অসচেতনতায় তার নাম বাদ দিয়ে আরেকজনের নামে সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ নেয়া হয়ে গেছে, ফলে সেটি সেভাবেই পরিচিত হবে! অতি আশ্চর্য এক ব্যপার! টাঙ্গাইলের জনপ্রতিনিধি এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেন না।

এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে সাংসদ হিসেবে জীবনের প্রথম ভাষণে ফুলবাড়ীয়ার নবনির্বাচিত সাংসদ আব্দুল মালেক সরকার ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলার জাতীয় স্বীকৃতি ও দেশে-বিদেশে প্রচারণার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছেন।

উপরোক্ত ঘটনা দুটির একটি আমাদের জাতীয়-আন্তর্জাতিক ইস্যু, অন্যটি আপাতদৃষ্টিতে আঞ্চলিক। তবে, ফুলবাড়ীয়া ও টাঙ্গাইলের মাঝে ভৌগলিক দূরত্ব খুব বেশি না হওয়া এবং ঘটনা দুটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় এই আলোচনার সূত্রপাত করেছি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটতে ঘটতে বর্তমান পৃথিবী এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা ও আত্মমর্যাদা রক্ষা করাকে প্রতিটি মানুষ নিজেদের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করে। মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ সারাবিশ্বেই বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। পাশাপাশি প্রতিটি সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পণ্য কিংবা সংস্কৃতি, সবকিছুরই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মৌলিক পরিচয় প্রতিষ্ঠায় বিশেষ উদ্যোগী হয়েছে। কোনো দেশের সীমান্ত রক্ষা যেমন জরুরি, সেদেশের নিজস্ব পণ্যসামগ্রী থেকে সংস্কৃতি, সেগুলোরও পেটেন্ট রক্ষা করা অধিকতর জরুরি হয়ে পড়েছে।

সংস্কৃতি হল কোনো সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন সামাজিক আচরণ ও নিয়মকানুনের সামষ্টিক বহিঃপ্রকাশ। কোনো স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, প্রথা-পার্বণ ইত্যাদির মাধ্যমে যে সামষ্টিক অভিব্যক্তি প্রকাশ হয়, তাই সংস্কৃতি। এক কথায় বলতে গেলে, সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজবদ্ধ মানুষের টিকে থাকার কৌশল। নৃবিজ্ঞানী টেইলরের মতে, সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয়ের নামই সংস্কৃতি।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী হলফনামা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, জাতীয় সংসদের ১৫১, ময়মনসিংহ – ০৬ (ফুলবাড়ীয়া) আসনের নবনির্বাচিত সাংসদ আব্দুল মালেক সরকার একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। নির্বাচনের আগে-পরে অনেক উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীকে রীতিমত পরাস্ত করে ফুলবাড়ীয়ার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিপক্ষরা নির্বাচনের আগে যেমন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে উপহাসমূলক সমালোচনা করেছেন, নির্বাচিত হবার পরও তারা সুযোগ পেলেই তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত এই বিষয়ে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য ছুঁড়ে দিতে ওঁৎ পেতে বসে থাকেন।

ফুলবাড়ীয়ার অধিকাংশ মানুষ এখনো নিরক্ষর এবং অতি সাধারণ তাদের জীবনাচরণ। তাদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আব্দুল মালেক সরকার প্রতিপক্ষের যাবতীয় কটাক্ষকে থোড়াই কেয়ার করেন। এর প্রমাণ তিনি দিয়েছেন মহান জাতীয় সংসদে প্রদত্ত জীবনের প্রথম ভাষণে। অল্প কিছুদিন আগেই ফুলবাড়ীয়ার ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি জনতাকে কথা দিয়েছিলেন, জাতীয় সংসদে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি চাইবেন। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কথা রেখেছেন। সংসদে তিনি হুমগুটি খেলা ও একে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত গ্রামীণ মেলাকে অত্র অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে জাতীয় স্বীকৃতি চেয়েছেন এবং দেশে-বিদেশে এর প্রচারের দাবি জানিয়েছেন।

হুমগুটি হল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় লক্ষ্মীপুরের বড়ই আটায় তালুক-পরগনার সীমানায় অনুষ্ঠিত একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা। ২৬৫ বছর আগে মুক্তাগাছার জমিদারের সঙ্গে ত্রিশালের বৈলরের জমিদারের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। তখনকার দিনে তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে, পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের জমিতে দুই নীতির কারণে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই বিরোধ মীমাংসা করার জন্য লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে ‘তালুক-পরগনার সীমানায়’ এই গুটি খেলার আয়োজন শুরু করা হয়। গুটি খেলার শর্ত ছিল একটি পিতলের তৈরি ৪০ কেজির গোলাকার বল বা গুটি গুমকারী এলাকাকে ‘তালুক’ এবং পরাজিত অংশের নাম হবে ‘পরগনা’। মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয় জমিদার আমলের সেই গুটি খেলায়।

বিরোধ মীমাংসা হয়ে গেলেও ও জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও স্থানীয় জনগণের নিজস্ব উদ্যোগে সেই থেকে অদ্যাবধি প্রতি বছর পৌষ মাসের শেষ দিন এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়। হুমগুটি খেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ মেলা বসে, বিবাহিত নারীরা বাপের বাড়ি নাইওর আসেন, কর্মজীবি মানুষ ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেন। ফলে, ফুলবাড়ীয়া, ত্রিশাল ও সদর উপজেলায় এই খেলা ও মেলাকে কেন্দ্র করে সপ্তাহব্যপী লোকজ উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়।

ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, একটি জাতির সংস্কৃতি বাস করে দেশের জনগণের হৃদয় ও আত্মার মাঝে। সে হিসেবে ফুলবাড়ীয়া জনপদের মানুষের সামষ্টিক উৎসবের উপলক্ষ্য হিসেবে হুমগুটি খেলা শত বছরের ঐতিহ্যের ধারক।

জ্যামাইকান কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী নেতা মার্কাস গারভে বলেছিলেন, যে ব্যাক্তির তাদের পূর্বের ইতিহাস, বংশ এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে কোন জ্ঞান নাই, সে হল শেকড় বিহীন গাছের মত। ফুলবাড়ীয়ার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি  হিসেবে জীবনের প্রথম সংসদীয় ভাষণে আলহাজ্ব আব্দুল মালেক সরকার বুঝিয়ে দিলেন, তিনি এমন এক জনপদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যার শেকড় শত বছরের সাংস্কৃতিক ভিত্তির গভীরে প্রোত্থিত।

প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত। বর্তমান সময়ের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এ ধরনের শিক্ষায় পরীক্ষা পাশ কিংবা কিছু সনদ লাভ করা গেলেও প্রকৃতপক্ষে আলোকিত মানুষ হওয়া যায় না। এ ধরনের শিক্ষা প্রকৃত অর্থে জ্ঞানার্জনের জন্য নয় বরং জীবিকা অর্জনের জন্যে। তাই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চ ডিগ্রি লাভ করলেই সুশিক্ষিত হওয়া যায় না। আমাদের সমাজে এমন অনেকে আছেন যারা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা লাভ না করেই প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং সংগ্রামময় জীবন থেকে অনেক কিছু শিখে স্বশিক্ষিত হয়েছেন। তাঁদের জ্ঞান, দর্শন, আচার-আচরণ ও শিক্ষা মানুষকে মুগ্ধ করে। তারা তাদের জ্ঞানের আলােয় চারিদিক আলােকিত করে তােলেন।

ফুলবাড়ীয়ার মানুষের প্রতিনিধি আলহাজ্ব আব্দুল মালেক সরকার এম.পি. একজন স্বশিক্ষিত ও বিচক্ষণ নেতা হিসেবে তাই সাংসদ-জীবনের সূচনালগ্নে নিজের শেকড়ের জাতীয় স্বীকৃতি আদায় করে নিলেন। একজন ভোটার হিসেবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ এই জনপদে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রারম্ভে তাঁর এই আত্মমর্যাদাবান সৎ সাহসের জন্য সাধুবাদ জ্ঞাপন করছি। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে তাঁর মত প্রকৃত জীবনবোধের অধিকারী সাংসদকে অন্তর্ভূক্ত করায় সংসদ নেতা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ। আসুন, পুঁথিগত বিদ্যার মিথ্যা অহমিকায় এলিটিসিজমে গা না ভাসিয়ে মাটির সাথে মিশে মাটির শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করে সমৃদ্ধ আগামীর দিকে এগিয়ে যাই। এতে অন্ততপক্ষে, নেতৃত্বের অদূরদর্শিতায় টাঙ্গাইলের শাড়ির মত বেহাত হওয়া থেকে রক্ষা পাব।

লেখক: উদ্যোক্তা ও সংগঠক (ইমেইল: contact@mkawser.com)

বেহাত টাঙ্গাইলের শাড়ি বনাম সংসদে ঐতিহ্যের হুমগুটি

প্রকাশের সময়: ০১:৫৫:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

ময়মনসিংহ: সম্প্রতি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়িকে নিজেদের ‘ভৌগোলিক নির্দেশক’ বা জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করে নিয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। এ নিয়ে দুইদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সচেতন মানুষের মাঝে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।

‘টাঙ্গাইলের শাড়ি’ নামের মাঝেই বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলাকে নির্দেশ করলেও ভারত পশ্চিমবঙ্গের নামে এর পেটেন্ট নিয়ে নেওয়ায় সারা পৃথিবীর মানুষ এখন থেকে জানবে এই উৎকৃষ্ট মানের শাড়ি ভারতের সম্পদ। ফলে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি বিশ্ববাজারে মূল্য হারাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাঁতশিল্প।

এটি এমন এক বিষয়, যেন জন্মদাতার অসচেতনতায় তার নাম বাদ দিয়ে আরেকজনের নামে সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ নেয়া হয়ে গেছে, ফলে সেটি সেভাবেই পরিচিত হবে! অতি আশ্চর্য এক ব্যপার! টাঙ্গাইলের জনপ্রতিনিধি এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেন না।

এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে সাংসদ হিসেবে জীবনের প্রথম ভাষণে ফুলবাড়ীয়ার নবনির্বাচিত সাংসদ আব্দুল মালেক সরকার ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলার জাতীয় স্বীকৃতি ও দেশে-বিদেশে প্রচারণার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছেন।

উপরোক্ত ঘটনা দুটির একটি আমাদের জাতীয়-আন্তর্জাতিক ইস্যু, অন্যটি আপাতদৃষ্টিতে আঞ্চলিক। তবে, ফুলবাড়ীয়া ও টাঙ্গাইলের মাঝে ভৌগলিক দূরত্ব খুব বেশি না হওয়া এবং ঘটনা দুটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় এই আলোচনার সূত্রপাত করেছি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটতে ঘটতে বর্তমান পৃথিবী এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা ও আত্মমর্যাদা রক্ষা করাকে প্রতিটি মানুষ নিজেদের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করে। মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ সারাবিশ্বেই বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। পাশাপাশি প্রতিটি সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পণ্য কিংবা সংস্কৃতি, সবকিছুরই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মৌলিক পরিচয় প্রতিষ্ঠায় বিশেষ উদ্যোগী হয়েছে। কোনো দেশের সীমান্ত রক্ষা যেমন জরুরি, সেদেশের নিজস্ব পণ্যসামগ্রী থেকে সংস্কৃতি, সেগুলোরও পেটেন্ট রক্ষা করা অধিকতর জরুরি হয়ে পড়েছে।

সংস্কৃতি হল কোনো সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন সামাজিক আচরণ ও নিয়মকানুনের সামষ্টিক বহিঃপ্রকাশ। কোনো স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, প্রথা-পার্বণ ইত্যাদির মাধ্যমে যে সামষ্টিক অভিব্যক্তি প্রকাশ হয়, তাই সংস্কৃতি। এক কথায় বলতে গেলে, সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজবদ্ধ মানুষের টিকে থাকার কৌশল। নৃবিজ্ঞানী টেইলরের মতে, সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয়ের নামই সংস্কৃতি।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী হলফনামা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, জাতীয় সংসদের ১৫১, ময়মনসিংহ – ০৬ (ফুলবাড়ীয়া) আসনের নবনির্বাচিত সাংসদ আব্দুল মালেক সরকার একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। নির্বাচনের আগে-পরে অনেক উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীকে রীতিমত পরাস্ত করে ফুলবাড়ীয়ার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিপক্ষরা নির্বাচনের আগে যেমন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে উপহাসমূলক সমালোচনা করেছেন, নির্বাচিত হবার পরও তারা সুযোগ পেলেই তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত এই বিষয়ে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য ছুঁড়ে দিতে ওঁৎ পেতে বসে থাকেন।

ফুলবাড়ীয়ার অধিকাংশ মানুষ এখনো নিরক্ষর এবং অতি সাধারণ তাদের জীবনাচরণ। তাদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আব্দুল মালেক সরকার প্রতিপক্ষের যাবতীয় কটাক্ষকে থোড়াই কেয়ার করেন। এর প্রমাণ তিনি দিয়েছেন মহান জাতীয় সংসদে প্রদত্ত জীবনের প্রথম ভাষণে। অল্প কিছুদিন আগেই ফুলবাড়ীয়ার ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি জনতাকে কথা দিয়েছিলেন, জাতীয় সংসদে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি চাইবেন। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কথা রেখেছেন। সংসদে তিনি হুমগুটি খেলা ও একে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত গ্রামীণ মেলাকে অত্র অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে জাতীয় স্বীকৃতি চেয়েছেন এবং দেশে-বিদেশে এর প্রচারের দাবি জানিয়েছেন।

হুমগুটি হল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় লক্ষ্মীপুরের বড়ই আটায় তালুক-পরগনার সীমানায় অনুষ্ঠিত একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা। ২৬৫ বছর আগে মুক্তাগাছার জমিদারের সঙ্গে ত্রিশালের বৈলরের জমিদারের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। তখনকার দিনে তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে, পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের জমিতে দুই নীতির কারণে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই বিরোধ মীমাংসা করার জন্য লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে ‘তালুক-পরগনার সীমানায়’ এই গুটি খেলার আয়োজন শুরু করা হয়। গুটি খেলার শর্ত ছিল একটি পিতলের তৈরি ৪০ কেজির গোলাকার বল বা গুটি গুমকারী এলাকাকে ‘তালুক’ এবং পরাজিত অংশের নাম হবে ‘পরগনা’। মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয় জমিদার আমলের সেই গুটি খেলায়।

বিরোধ মীমাংসা হয়ে গেলেও ও জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও স্থানীয় জনগণের নিজস্ব উদ্যোগে সেই থেকে অদ্যাবধি প্রতি বছর পৌষ মাসের শেষ দিন এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়। হুমগুটি খেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ মেলা বসে, বিবাহিত নারীরা বাপের বাড়ি নাইওর আসেন, কর্মজীবি মানুষ ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেন। ফলে, ফুলবাড়ীয়া, ত্রিশাল ও সদর উপজেলায় এই খেলা ও মেলাকে কেন্দ্র করে সপ্তাহব্যপী লোকজ উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়।

ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, একটি জাতির সংস্কৃতি বাস করে দেশের জনগণের হৃদয় ও আত্মার মাঝে। সে হিসেবে ফুলবাড়ীয়া জনপদের মানুষের সামষ্টিক উৎসবের উপলক্ষ্য হিসেবে হুমগুটি খেলা শত বছরের ঐতিহ্যের ধারক।

জ্যামাইকান কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী নেতা মার্কাস গারভে বলেছিলেন, যে ব্যাক্তির তাদের পূর্বের ইতিহাস, বংশ এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে কোন জ্ঞান নাই, সে হল শেকড় বিহীন গাছের মত। ফুলবাড়ীয়ার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি  হিসেবে জীবনের প্রথম সংসদীয় ভাষণে আলহাজ্ব আব্দুল মালেক সরকার বুঝিয়ে দিলেন, তিনি এমন এক জনপদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যার শেকড় শত বছরের সাংস্কৃতিক ভিত্তির গভীরে প্রোত্থিত।

প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত। বর্তমান সময়ের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এ ধরনের শিক্ষায় পরীক্ষা পাশ কিংবা কিছু সনদ লাভ করা গেলেও প্রকৃতপক্ষে আলোকিত মানুষ হওয়া যায় না। এ ধরনের শিক্ষা প্রকৃত অর্থে জ্ঞানার্জনের জন্য নয় বরং জীবিকা অর্জনের জন্যে। তাই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চ ডিগ্রি লাভ করলেই সুশিক্ষিত হওয়া যায় না। আমাদের সমাজে এমন অনেকে আছেন যারা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা লাভ না করেই প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং সংগ্রামময় জীবন থেকে অনেক কিছু শিখে স্বশিক্ষিত হয়েছেন। তাঁদের জ্ঞান, দর্শন, আচার-আচরণ ও শিক্ষা মানুষকে মুগ্ধ করে। তারা তাদের জ্ঞানের আলােয় চারিদিক আলােকিত করে তােলেন।

ফুলবাড়ীয়ার মানুষের প্রতিনিধি আলহাজ্ব আব্দুল মালেক সরকার এম.পি. একজন স্বশিক্ষিত ও বিচক্ষণ নেতা হিসেবে তাই সাংসদ-জীবনের সূচনালগ্নে নিজের শেকড়ের জাতীয় স্বীকৃতি আদায় করে নিলেন। একজন ভোটার হিসেবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ এই জনপদে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রারম্ভে তাঁর এই আত্মমর্যাদাবান সৎ সাহসের জন্য সাধুবাদ জ্ঞাপন করছি। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে তাঁর মত প্রকৃত জীবনবোধের অধিকারী সাংসদকে অন্তর্ভূক্ত করায় সংসদ নেতা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ। আসুন, পুঁথিগত বিদ্যার মিথ্যা অহমিকায় এলিটিসিজমে গা না ভাসিয়ে মাটির সাথে মিশে মাটির শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করে সমৃদ্ধ আগামীর দিকে এগিয়ে যাই। এতে অন্ততপক্ষে, নেতৃত্বের অদূরদর্শিতায় টাঙ্গাইলের শাড়ির মত বেহাত হওয়া থেকে রক্ষা পাব।

লেখক: উদ্যোক্তা ও সংগঠক (ইমেইল: contact@mkawser.com)