ময়মনসিংহ: এক যুগ আগে যখন পাঠাগার আর বই পড়া নিয়ে কথা বলতাম, বেশিরভাগ মানুষ হাসাহাসি করত। গুটিকয়েক শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়া সবাই অসহযোগিতা করেছেন, মুরুব্বিদের কেউ কেউ তো রীতিমত প্রতিরোধের চেষ্টা করেছেন।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পাঠাগার সম্পাদকের মাধ্যমে একটি নির্দেশে খুব সহজেই সারাদেশে এই বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু তখন অনেক চেষ্টাতেও তা করাতে পারিনি। তখন ছাত্ররাজনীতি ছিল দৈনিক পীরের দরবারে হাজিরা দিয়ে কদমবুসি করা, পেশীশক্তি আর ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া৷ ক্যাডার-নির্ভর সেই ছাত্ররাজনীতি থেকে সারাদেশে অসংখ্য মাদক কারবারি, সন্ত্রাসী আর লুটেরা ছাড়া আর কিছু পায়নি জাতি।
হাইকমান্ডের কৌশলী উদ্ভাবনী চিন্তা থেকে বিগত কমিটিগুলোতে মেধাভিত্তিক ছাত্রনেতাদের হাতে ছাত্ররাজনীতির ভার তুলে দেয়ায় হঠাৎ নেতৃত্বের পট-পরিবর্তনে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ঘটেছে। এর ক্রমবিকাশ ঘটতে ঘটতে অন্তত দশ বছরের ব্যবধানে অনেকাংশেই বুদ্ধিবৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির পথ সুগম হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে জাতি সুস্থ ছাত্ররাজনীতির স্বাদ ভোগ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।
এখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সরাসরি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন। পাঠাগার আন্দোলনকে তারা নিজেরাও বেগবান করতে তৎপর হয়েছেন। এটি অবশ্যই আনন্দের।
আমার এলাকায় দশ বছর আগে ক্লাব করার প্রতিযোগিতা হত। ক্লাবে চলত মাদক আর জুয়ার আড্ডা, ক্লাবের প্রোগ্রাম বলতে ছিল অশ্লীল গানের কনসার্ট কিংবা বনভোজনের নামে আরেক দফা বেহায়াপনা। ক্লাবের প্রধান ডিউটি ছিল নির্বাচনে কোনো নেতার পক্ষে পেশীশক্তি আর সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা পালন।
আমি যখন এই অপসংস্কৃতির অবসান ঘটাতে পাঠাগার স্থাপন করলাম, তখনো রাতারাতি অবৈধ অর্থ ও অস্ত্রের দাপটে ক্লাবের পর ক্লাব গড়ে ভয়ভীতি আর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাঠাগার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা চলেছে। হামলা-মামলা-নির্যাতন কোনো চেষ্টারই কমতি রাখেনি সমাজবিরোধীরা।
সবকিছু নীরবে সয়ে লক্ষ্যে অবিচল ছিলাম। আমার প্রজন্মের সাহসী ভূমিকা আর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আজ পরিবেশ বদলে গেছে। জানলে অবাক হবেন, এখন আমার এই অঞ্চলে অসংখ্য পাঠাগার গড়ে উঠেছে। এসব পাঠাগারের প্রগতিশীল, বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ভাবনী সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামগুলো এত নির্মল আর সুস্থ বিনোদনের উৎস হয়েছে যে, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেরই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
এখন এক পাঠাগারের সাথে পাল্লা দিয়ে আরেক পাঠাগারের এই সুস্থ নান্দনিক আয়োজনের প্রতিযোগিতা, এর মাধ্যমে আমাদের নতুন প্রজন্ম এক ভিন্নরকম মানসিক উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি আশাবাদী, এই প্রজন্ম আর দিকভ্রান্ত হবে না, ইনশাআল্লাহ।
তবে, যেসব তরুণেরা এই আন্দোলনের শরীক হয়েছেন, তাদের আরও সতর্ক হতে হবে। সমাজবিরোধী রাঘববোয়ালরা সরাসরি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন, তা স্পষ্ট। অর্থ আর ক্ষমতা বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের প্রধান অন্তরায়। বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে অর্থ-ক্ষমতার ভূমিকা গৌণ। কিন্তু ওরা লোভ দেখিয়ে প্রজন্মকে কৌশলে বিপথগামী করতে মরিয়া। মনে রাখবেন, লাইব্রেরি ফান্ডের অস্বাভাবিক উন্নতি কমবয়সী তরুণদের মাথানষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের পাঠাগারের ফান্ড সবসময় শূণ্য রাখতে চেষ্টা করেছি। প্রোগ্রাম করেছি নিজেদের টাকায় সীমিত ব্যয়ে সাধ্যের মধ্যে সবটুকু ভালবাসা ঢেলে দিয়ে। কাড়ি-কাড়ি টাকা আর অস্বাভাবিক ক্ষমতা বই পড়ার চেয়ে হিসেব-নিকেশ করাতে ব্যস্ত করে ফেলে। তাই বিগড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। পাঠাগার আন্দোলনের সৈনিকেরা এটি মাথায় রাখবেন। আর কোনো প্রভাবশালী কিংবা প্রভাব বিস্তারকারী একক ব্যক্তির নিকট পাঠাগারকে দায়বদ্ধ করবেন না। এতে ঐ ব্যক্তি আপনাদেরকে ব্যবহার করে নিজেকে ক্ষমতাবান করার ও অন্যায় সুবিধালাভের সুযোগ পান।
পাঠাগার তখন সফল, যখন পাঠক সৃষ্টি হবে। মনে রাখবেন, পাঠকবিহীন পাঠাগারের চেয়ে মাদকসেবীদের ক্লাব ভাল। আর লোভী তারুণ্যের চেয়ে মৃত সমাজ ভাল। লোভ পরিহার করতে হবে। নৈতিকতা অটুট রাখতে হবে।
ভাল কাজের প্রতিযোগিতা চলুক। প্রজন্ম বিকশিত হোক। জয় বাংলা।
লেখক: উদ্যোক্তা ও সংগঠক