ময়মনসিংহ: অনার্সে ভালো ফলাফলের পর গোলাম সারোয়ারের পরিকল্পনা ছিল উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাবেন। কিন্তু করোনা মহামারির সময় মা-বাবার সঙ্গে কিছু দিন থেকে বুঝতে পারলেন তাদের দুনিয়াটা তাকে ঘিরেই। তাদের সঙ্গে নিয়েই এই জনম কাটিয়ে দেওয়ার প্ল্যান যখন হলো, তখনই বিসিএসের পরিকল্পনা শুরু করলেন। যথাযথ পরিশ্রম আর লক্ষ্যের প্রতি অটল থেকে অবশেষে নিজের প্রথম বিসিএস পরীক্ষাতেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এল। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী গোলাম সারোয়ার রবিন ৪৩তম বিসিএসে ট্যাক্স ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার গগডা কোনাপাড়ায় গোলাম সারোয়ারের বাড়ি। তিনি তার গ্রামের প্রথম বিসিএস ক্যাডার। বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক এসআই, বর্তমানে গগডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। গোলাম সারোয়ার গগডা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে জিপিএ-৫ এবং শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ ময়মনসিংহ থেকে বিজ্ঞান শাখায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ২০১৪-১৫ সেশনে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
নিজের সাফল্যের অনুভূতি জানিয়ে গোলাম সারোয়ার বলেন, রেজাল্ট প্রকাশের দিন পরিবারের সবাই সব কাজ ফেলে বাড়িতেই ছিল। রেজাল্ট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নিজের রোলটা পিডিএফ সার্চ বক্সে লিখে বিসমিল্লাহ্ বলে ক্লিক করলাম। যখন দেখলাম ট্যাক্সে ২১ নাম্বারে আমার রোলটা, তখন দৌড়ে আমার রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম, ছোটবোন আবার মিলিয়ে দেখলো। প্রথম কয়েক মিনিট সবাই চুপচাপ, বিষয়টা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। আব্বা-আম্মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে। অনুভূতিটি বলে বুঝানো সম্ভব নয়। আমার এই সাফল্যের পিছনে বাবা-মা, বোনেরা, শিক্ষক, কলিগ, আত্মীয়-স্বজন পরিচিত অনেক বড় ভাই, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অনেক অবদান রয়েছে।
প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রস্তুতির শুরুটা আকস্মিক ছিল। প্ল্যান অনুযায়ী অনার্সে ভালো রেজাল্ট করলাম। থিসিস পেপার পাবলিশ করলাম উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাবো বলে। কিন্তু করোনা মহামারির সময় মা-বাবার সঙ্গে কিছু দিন থেকে বুঝতে পারলাম তাদের দুনিয়াটা আমাকে ঘিরে। তাদের সঙ্গে নিয়েই এই জনম কাটিয়ে দেওয়ার প্ল্যান যখন হলো, তখন বিসিএসের পরিকল্পনা শুরু করলাম। আমি সাইন্সের স্টুডেন্ট, আমরা স্ট্র্যাটিজিও আমি সাইন্টিফিক ওয়েতে তৈরি করলাম। বাজারে অসংখ্য বই থেকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী সাবজেক্টটিভ বই কিনে যাত্রা শুরু। শুরুতে আমি সিলেবাস দেখে উইকজোন খুঁজে বের করলাম তারপর নিজের উইকজোনগুলোকে স্ট্রংজোন বানানোর চেষ্টা করলাম। প্রথমে মাথায় এটা সেট করে নিলাম যে, আমি জেনারেল প্রার্থী, তাই ভালো ক্যাডার হতে হলে আমাকে টোটাল মেরিট এ ৫০০ এর ভিতরে থাকতে হবে। আমার বাবা-মা খুবই স্বপ্নবাজ মানুষ, আমি গ্রামে বড় হয়েছি কিন্তু আমার বাবা-মা আমাকে সীমাহীন স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। আমার গ্রামে কোনো বিসিএস ক্যাডার ছিল না তাই তাদের খুব ইচ্ছে আমি যেন হই। অবশেষে আমার গ্রামের প্রথম বিসিএস ক্যাডার আমি হতে পেরেছি।
পরিবার সম্পর্কে তিনি বলেন, পরিবার সম্পর্কে বলতে গেলে গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একজন মানুষ আমি। আর্থিক অবস্থা মোটামুটি হলেও মা-বাবার সাহস ছিল অপরিসীম। তারা কখনো মনোবল হারায়নি। সব সময় সাহস দিয়েছে যে, আমরা আছি, তোমার যেটা ভালো লাগবে তাই করবা। এক কথায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমার স্বাধীনতা ছিল। সেই স্বাধীনতা পেয়েছি বলেই তিনটা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিসিএসের পিছনে ছুটতে পেরেছি।
গোলামা সারোয়ারের বাবা মো. শামছুর রহমান বলেন, ছেলের সফলতায় আমরা সবাই খুশি। গগডা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম জিপিএ-৫ পাওয়ার পর থেকে সবাই আরো বেশি আশাবাদী। ছোটবেলা থেকেই গ্রামের সবাই ওকে চিনে সম্ভাবনাময় ছাত্র হিসেবে। ব্যক্তিগতভাবে চিনে না কিন্তু রবিন নামে একটি ছাত্র আছে গ্রামে এটা সবাই জানে। গ্রামের প্রথম বিসিএস ক্যাডার হওয়ায় গ্রামের সবাই তার প্রশংসা করছেন। বলছে, আপনার ছেলে গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছে। বাবা হিসেবে এর থেকে প্রাপ্তির কি হতে পারে?
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মহিনুজ্জামন মঈন বলেন, ছাত্র হিসেবে সে খুব মেধাবী, ক্রিয়েটিভ এবং স্মার্ট। তাকে নিয়ে আমাদের আশা ছিল, সে হতাশ করেনি। তার সাফল্যে আমরা গর্বিত।