[হাওড়-বাওড় আর মইষের শিং -এই নিয়ে ময়মনসিংহ। প্রিয় পাঠক, হাজার বছরের ইতিহাসে ময়মনসিংহের যেসব কৃতি সন্তান তাঁদের মেধা-মননশীলতা ও কর্মের মাধ্যমে এই মাটিকে গৌরবান্বিত করেছেন, ২০১৬-২০১৭ সালে একবিংশ শতকের নতুন প্রজন্মের কাছে সেইসব মনীষীর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল ময়মনসিংহ বিভাগভিত্তিক প্রথম ও একমাত্র অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘ময়মনসিংহ ডিভিশন টুয়েন্টিফোর ডটকম’। সেই ধারাবাহিকতার পঞ্চম পর্বে ছিল ময়মনসিংহের কৃতি সন্তান আবুল কালাম শামছুদ্দীন’র জীবনী। প্রিয় পাঠক, আপনাদের সেই প্রিয় পোর্টালেরই বিবর্তিত প্ল্যাটফর্ম ‘প্রতিদিনের ময়মনসিংহ’ লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করল]
ময়মনসিংহ: উপমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির প্রথম দিকের একজন সক্রিয় কর্মী ও নেতা আবুল কালাম শামছুদ্দীন ছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার সাধারণ নাগরিকদের কাছে একজন আইকন। এই কিংবদন্তী ব্যাক্তিত্ব একাধারে ছিলেন একজন সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ। ১৮৯৭ সালের ৩ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের ধানীখোলা গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। আরেক কিংবদন্তী ব্যাক্তিত্ব আবুল মনসুর আহম্মেদ তাঁর বাল্যবন্ধু ছিলেন।
১৯১৭ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর তিনি ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাস করেন এবং পরবর্তীতে কলকাতার রিপন কলেজে বিএ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু ওই সময় মুসলিম জাহানের খিলাফত রক্ষায় আলী ভ্রাতৃদ্বয় (মুহম্মদ আলী ও শওকত আলী), আবুল কালাম আজাদ, ড. এম. এ আনসারী ও হসরত মোহানীর নেতৃত্বে ভারতে ‘খিলাফত আন্দোলন’ এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড ও ১৯১৯ সালের ‘রাওলাট অ্যাক্ট’কে সরকারি নির্যাতনের প্রমাণরূপে চিহ্নিত করে এর প্রতিবাদে মহাত্মা গান্ধী কতৃক পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন এবং বিএ পরীক্ষা না দিয়ে কলকাতার গৌড়ীয় সুবর্ণ বিদ্যায়তন থেকে উপাধি পরীক্ষা (১৯২১) পাস করেন।
এরপর কিছুদিনের জন্য তিনি নিজ শহরে ফিরে আসেন এবং এখানে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এসময়ই তিনি নিজ এলাকায় রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। ১৯২২ সালে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। পরে তিনি ‘সাপ্তাহিক মোসলেম জগৎ’, ‘দি মুসলমান’, ‘দৈনিক সোলতান’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’ প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এরপর ১৯৩৬ সালে তিনি দৈনিক আজাদে যোগদান করেন এবং একাধারে ১৯৪০-৬২ সাল পর্যন্ত এই জনপ্রিয় ও পাঠক নন্দিত পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৬৪ সালে তিনি ‘প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান’ পরিচালিত ‘দৈনিক পাকিস্তানে’র সম্পাদক নিযুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের ঘটনায় তিনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। এরপর ১৯২৭ সালে তিনি মুসলিম লীগের সদস্যপদও লাভ করেন। ১৯৪২ সালে কলকাতায় পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হলে তিনি এর সভাপতিরূপে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি ময়মনসিংহ থেকে ভারতীয় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ভাষা প্রশ্নে দ্বন্দ্বের দেখা দিলে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে মতামত দেন এবং ১৯৪৯ সালে পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা-কমিটির সদস্য হন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তিনি আইন পরিষদের সদস্যপদ ও মুসলিম লীগ সংসদীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে প্রথমবার যে শহীদ মিনার নির্মিত হয়, আবুল কালাম শামসুদ্দীন তার উদ্বোধন করেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে শেরে-বাংলা এবং সোহরাওয়ার্দী সম্মিলিতভাবে তাঁকে যুক্তফ্রন্টে আসার অনুরোধ জানান এবং যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে নির্বাচন করার প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু তিনি মুসলিম লীগের নীতির পরিবর্তন দলের ভেতর থেকেই করার পক্ষে মত দেন এবং হার নিশ্চিত জেনেও মুসলিম লীগের মনোনয়নেই নির্বাচনে প্রার্থীতা করেন। নির্বাচনে তিনি তাঁর কাছের বন্ধু আবুল মনসুর আহম্মেদের কাছে পরাজিত হন।
তিনি পাকিস্তান সরকারের শোষণ ও দুর্নীতির বিরোধিতা করলেও পাকিস্তানের অখন্ডতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘সিতারা-ই-খিদমত (১৯৬১)’ এবং ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬৭)’ উপাধিতে ভূষিত হন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে উভয় খেতাব বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’ এবং ১৯৭৬ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন।
আবুল কালাম শামছুদ্দীন একজন সফল সাহিত্যিকও ছিলেন। তাঁর রচিত ও অনূদিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘পোড়োজমি বা অনাবাদী জমি (১৯৩৮)’, ‘ত্রিস্রোতা (১৯৩৯)’, ‘খরতরঙ্গ (১৯৫৩)’, ‘দৃষ্টিকোণ (১৯৬১)’, ‘নতুন চীন নতুন দেশ (১৯৬৫)’, ‘দিগ্বিজয়ী তাইমুর (১৯৬৫)’, ‘ইলিয়ড (১৯৬৭)’, ‘পলাশী থেকে পাকিস্তান (১৯৬৮)’, ‘অতীত দিনের স্মৃতি (১৯৬৮)’ ইত্যাদি। আত্মজীবনী হিসেবে ‘অতীত জীবনের স্মৃতি’ তাঁর উৎকৃষ্ট রচনা। দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর এ গ্রন্থ প্রত্যক্ষদর্শীর দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
১৯৭৮ সালের ৪ মার্চ ঢাকায় এ মহান ব্যাক্তির জীবনাবসান ঘটে।
তথ্যসূত্র : আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, বাংলাপিডিয়া